অতীত ইতিহাস ( B.A )

পরবর্তী বৈদিক যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের একটি প্রামাণ্য বিবরণ দাও।

পরবর্তী বৈদিক যুগে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন : সামবেদ সংহিতা, যজুর্বেদ সংহিতা, অথর্ববেদ সংহিতা, সংহিতার সঙ্গে যুক্ত ব্রাহ্মণসমূহ, আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থগুলি থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন সম্বন্ধে জানা যায়।

পরবর্তী বৈদিক যুগে সামাজিক জীবন

পরবর্তী বৈদিক যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের একটি প্রামাণ্য বিবরণ দাও।
  • সামাজিক জীবনে জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি

পরবর্তী বৈদিক যুগের আর্যদের সামাজিক জীবনে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে। ব্রাহ্মাণ এবং ক্ষত্রিয় দিনে দিনে আরও অধিক মর্যাদার অধিকারী হয়। অন্যদিকে বৈশ্যরা সমাজে পূর্বে যে মর্যাদার অধিকারী ছিল তা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। শূদ্রের ভাগ্যে ঘৃণা এবং বিড়ম্বনা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। প্রাচীন বৈদিক আমলে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মধ্যে যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের

রীতি ছিল তা তিরোহিত হয় ও অসবর্ণ বিবাহ বিশেষ করে শূদ্রের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। এই সময়কালে বর্ণ হিসাবে ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়। ক্ষত্রিয় সম্প্রদায় এই সময় থেকে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকে। যদিও পরবর্তী বৈদিক সমাজ বর্ণাশ্রম বা জাতিভেদ প্রথার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা সত্ত্বেও অস্পৃশ্যতা সমাজকে তখন পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারে নি। কিন্তু একই সঙ্গে আবার বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করার প্রবণতাও দেখা যেতে থাকে।

  • নারীর মর্যাদা হ্রাস

ঋগ্বেদের কালে নারীরা সমাজে যে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিল পরবর্তী বৈদিক যুগে সেই মর্যাদা থেকে তারা বহুলাংশে বঞ্চিত হয়। নারীর মর্যাদা হ্রাসের প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় পুরুষের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথার প্রচলন। পুরুষ অপেক্ষা নারীকে হেয় বলে মনে করা হতে থাকে এবং কন্যাসন্তানের জন্ম পিতামাতার নিকট অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে। নারীকে মদ ও পাশার সমপর্যায়ভুক্ত বলে মনে করা হতে থাকে। নারী সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বিবাহের সময় কন্যাপক্ষকে যৌতুক দেবার রীতি প্রচলিত হয়।

  • শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের জন্য শিক্ষা

এই সময় শিক্ষা একমাত্র উচ্চবর্ণের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। চড়ুশশ্রম প্রথা যথাক্রমে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস অধিকতর নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত থেকে থাকে। ছাত্রদের শিক্ষার পাঠ্যবস্তু ছিল প্রধানতঃ বেদ, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি। খাদ্যবস্তু নির্বাচনে

এবং পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে অন্নই প্রধান খাদ্যবস্তু বলে বিবেচিত থেকে থাকে। মাংসাহার ভোজ্য তালিকায় প্রধান স্থান থেকে উৎখাত হয়। গোমাংস আহার এই সময় প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। সোমরস এবং সুরাপান কিন্তু পূর্বের ন্যায় প্রচলিত থাকে। পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে কার্পাস বস্ত্রের সঙ্গে পশমের বস্ত্র ব্যবহৃত থেকে থাকে।

পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজনৈতিক জীবন

  • রাজনৈতিক ক্ষমতার বিস্তার: সার্বভৌমত্ব স্থাপনের চেষ্টা

পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের রাজনৈতিক ক্ষমতার বিস্তার ঘটে। ঋগ্বেদের আমলে যে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছিল তার পরিবর্তে এখন শক্তিশালী সুবৃহৎ রাজ্যের আবির্ভাব ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে ঋগ্বেদের আমলের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী তাদের গৌরব ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। আর্যদের পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতে ক্ষমতা বিস্তারের ফলে কুরু, পাঞ্চাল প্রভৃতি নামের আর্যগোষ্ঠীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের পূর্ব গুরুত্ব এই সময়ে বহুলাংশে হ্রাস পায়। রাজনৈতিক আদর্শের ক্ষেত্রেও এই সময় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সার্বভৌম শক্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গরূপে অশ্বমেধ, রাজসূয় প্রভৃতি যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত থেকে থাকে। রাজ্যের অধিপতিগণ তখন শুধুমাত্র ‘রাজন’ নামেই সন্তুষ্ট না থেকে ‘সম্রাট’, ‘একরাট বা ‘বিরাট’ প্রভৃতি আখ্যা নিতে থাকেন।

এই সময় দৈবসত্ত্বে বিশ্বাসী রাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। পূর্ববর্তী সময়ে রাজা জনগণের মনোনীত ব্যক্তি বলেই বিবেচিত থেকেন। পরবর্তীকালে মনে করা হতে থাকে, রাজা দেবকুল থেকে উদ্ভুত এবং তিনি দৈববলে বলীয়ান হয়েই রাজ্যশাসনের অধিকারী হয়েছেন।

  • রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি

পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা এই সময় রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে রাজা অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি নিজেকে প্রজাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বলে মনে করতে থাকেন। অপরদিকে মর্ত্যে রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি, সুতরাং রাজা অভ্রান্ত এবং কোনরূপ দণ্ড পেতে পারেন না, এইরূপ তত্ত্ব পুরোহিতগণ প্রচার করতে থাকেন (“The king become not only exempt from punishment but also the lord of law.”)।

কিন্তু এ সত্ত্বেও এই সময়ে রাজারা প্রজাদের মতামত উপেক্ষা করতেন না। অথর্ববেদে রাজা এবং প্রজাদের মধ্যে সদ্ভাবই সুশাসনের বৈশিষ্ট্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সময়কালের সাহিত্যে এরূপ বিবরণ পাওয়া যায় যে, রাজা প্রজাদের দ্বারা রাজ্য থেকে নির্বাসিত হয়েছেন। এই কালের রাজ্যগুলিতে আয়তন বৃদ্ধির অঙ্গ হিসাবে নতুন নতুন রাজকর্মচারী পদের সৃষ্টি থেকে থাকে।

রাজ্যশাসন এখন অধিকতর সংগঠিত এবং সুসংবদ্ধ হয়। রাজকর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বংশ-কৌলীন্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হতে থাকে।

পরবর্তী বৈদিক যুগে অর্থনৈতিক জীবন

  • অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন: জমিদার শ্রেণীর আবির্ভাব

পরবর্তী বৈদিক যুগে সমাজ গ্রামকেন্দ্রিক এবং নগরকেন্দ্রিক রূপে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। গ্রাম্য সমাজে এই সময় ছোট ছোট জমির মালিক বহু সংখ্যক কৃষক পরিবারের পরিবর্তে বড় বড় কৃষিজমির অধিকারী জমিদার শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। কৃষি জনগণের প্রধান জীবিকায় পরিণত হয়। কৃষিকাজের ক্ষেত্রে নানা উন্নতি ঘটে।

এই সময় কৃষিক্ষেত্রে লৌহজাত নানা উন্নত ধরনের কৃষি-যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ও কর্ষিত জমির পরিমাণও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। উন্নত ধরনের ফসল এবং উন্নত ধরনের শস্যবীজ থেকে শস্য উৎপাদনের প্রচেষ্টা হতে থাকে।

পরবর্তী বৈদিক যুগে সভ্যতার অধিকতর বিকাশের অঙ্গ হিসাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্থলপথে ও জলপথে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই সময় দ্রব্যের দাম নির্ধারণের মান হিসাবে ‘নিষ্ক’ নামে একপ্রকার মুদ্রার প্রচলন হয়। পূর্ববর্তী সময়ে গরুর সংখ্যা দিয়ে জিনিসের দাম স্থির করা হত। বাণিজ্য-বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বণিক শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য বণিকশ্রেণী অর্থ ঋণ নিতে থাকে এবং এইভাবে সমাজে অর্থঋণদানকারী একটি শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। সামাজিক জীবনে জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা নতুন পেশার আবির্ভাব ঘটে। দ্বাররক্ষক, ধনুকনির্মাতা, পশুমাংসবিক্রেতা, নদী-পারাপারকারী প্রভৃতি বৃত্তিধারী মানুষ সমাজে দেখা দেয়।

====>>> আঞ্চলিকতাবাদে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলি

RANI250

My name is Rani Biswas, a web designer with six years of experience and the owner of dishacoachingcentre.com, a dedicated educational platform offering high-quality learning resources.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button