ভারতবর্ষে আঞ্চলিকতাবাদে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলি বিশ্লেষণ কর।

ভারতবর্ষে আঞ্চলিকতাবাদ : আঞ্চলিকতাবাদ হ’ল একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতি ভৌগোলিক এলাকার প্রতি তাৎপর্যমূলক এক ধরণের বিশেষ আনুগত্য। জাতীয় ভূ-খণ্ডের সঙ্গে অধিবাসীদের এক ধরনের সংযোগ সম্পর্কে বা টান থাকে। এর থেকে স্বতন্ত্র আর এক ধরনের সংযোগ সম্পর্ক বা আনুগত্য পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় ভূ-খন্ডে প্রশাসনিক বিভাজন বা প্রাদেশিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনুগত্য বা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এরকম সংযোগ সম্পর্ক বা আনুগত্য আঞ্চলিকতা হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
ভারাত আঞ্চলিকতাবাদের ধারণা : ভারতে আঞ্চলিকতাবাদের ধারণা বিশেষভাবে জটিল।ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে একাধিক উপঅঞ্চল বর্তমান। এই সমস্ত উপ অঞ্চলগুলি কালক্রমে অঙ্গরাজ্যে মর্যাদা লাভ করেছে। ভারতে ৭ টি প্রাকৃতিক অঞ্চল বর্তমান। এই কাঠামোর মধ্যে কমবেশী ৬০ টি সামাজিক, সাংস্কৃতিক উপঅঞ্চল আছে। এই সমস্ত উপঅঞ্চলের মধ্যে সমরূপতা পরিলক্ষিত * হয়। ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে এই ভাষাভাষী, বহু ধর্মাবলম্বী, বহু সম্প্রদায়ের মানুষ বর্তমান। এইরকম আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে আঞ্চলিকতাবাদ বিভিন্নভাবে অভিব্যক্তি লাভ করে।
ইক্কাল নারাইন (Iqbal Narain) তাঁর আঞ্চলিকতাবাদ –

“A conceptual Analysis in the Indian context” শীর্ষক রচনায় ভারতীয় আঞ্চলিকতাবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ডঃ নারাইনের মতে অন্যান্য দেশের মত ভারতের প্রেক্ষাপটেও আঞ্চলিকতাবাদ হল একটি অস্পষ্ট ধারণা। আঞ্চলিকতাবাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক বর্তমান। নেতিবাচক অর্থে আঞ্চলিকতাবাদের মাধ্যমে একটি অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে একক আপেক্ষিক বঞ্চনার চেতনা বা মনোভাব প্রকাশ লাভ করে এবং মনে করা হয় যে সরকারী কাজকর্মের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট বঞ্চনার সৃষ্টি হয়েছে। আবার ইতিবাচক অর্থে একটি অঞ্চলের অধিবাসীদের আত্মবিকাশের অনুসন্ধানই হল আঞ্চলিকতাবাদ। সমাজবিজ্ঞানী পেরুমলের মতে (C.A. Parumal) আঞ্চলিকতাবাদের বিষয়টি ভারতব্যাপী বর্তমান। ভারতে আঞ্চলিকতাবাদের প্রধানত চারটি বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।
- (ক) কতকগুলি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অধিবাসীদের পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা দাবী।
- (খ) কতকগুলি অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বতন্ত্র অঙ্গরাজ্য গঠনের দাবী।
- (গ) আন্তঃরাজ্য বিরোধের মীমাংসার ব্যাপারে কিছু মানুষের দাবী।
- (ঘ) নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের অধিবাসীদের ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবী।
ভারাত আঞ্চলিকতাবাদের বিকাশের কারণ
সামাজিক কারণ : –
জাতিগত স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক সমরূপতা স্বীকার করার কথা বলা হয়। বস্তুত জাতিগত স্থা সত্তেক ভিত্তিতে ভৌগোলিক আঞ্চলিকতাবাদের সৃষ্টি হয়। ভারতে নাগা, অসমীয়া, বাঙালী, বিহারী বা পাঞ্জাবী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মাধ্যমে জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ পায়। এছাড়া এই সমস্ত জাতিগোষ্ঠী একটি পৃথক ভৌগোলিক অঞ্চলে নিজেদের অভিন্ন অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখার উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
একইভাবে গোর্খাল্যাও আন্দোলনের সময় ভারতের নেপালীদের জন্য পৃথক এলাকার দাবী করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসম্প্রদায় তাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সামাজিক, আঞ্চলিকতাবাদের জন্ম দেয়। যেমন- মহারাষ্ট্রে চাকরী নিয়োগের ক্ষেত্রে শিবসেনা মারাঠা যুবকদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দাবী করে।
১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠন আইন অনুসারে ভারতে রাজ্য পুনর্গঠনের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের এই ব্যবস্থার পরেও ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিজেদের স্বতন্ত্র অঞ্চলের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলনে সামিল হয়। উদাহরণ হিসেবে ঝাড়খন্ড, গোর্খাল্যান্ড, পাঞ্জাব, সুবা, উত্তরাখণ্ড প্রভৃতি আন্দোলনের কথা বলা যায়।
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকার আদিবাসীরাও তাদের ভৌগোলিক ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্যতার জন্য আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে এবং এর ফলে বেশ কিছু স্বতন্ত্র অঙ্গরাজ্য গড়ে ওঠে, যেমন- পাহাড়ে নাগাদের জন্য নাগাল্যান্ড, মিজোদের জন্য পৃথক রাজ্য মিজোরাম, খাসি ও গারো উপজাতিদের জন্য মেঘালয় রাজ্য গড়ে ওঠে। একইভাবে পাহাড়ী উপজাতিদের জন্য অরুণাচলপ্রদেশ গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ২০০০ সালে উত্তরাঞ্চল, ছত্রিশগড় ও ঝাড়খণ্ড রাজ্য গড়ে ওঠে।
এখানে কিন্তু পাহাড়ের উপজাতিদের পৃথক অঙ্গরাজ্যের দাবীর পরিসমাপ্তি ঘটেনি। অসমের বোরো উপজাতির মানুষ উদয়াচল রাজ্য, অসমের পৃথক ‘পূর্বাচল’ ও কারবি অ্যাংলং রাজ্য, মধ্যপ্রদেশের মহাঘোসলা ও মধ্যভারত রাজ্য, উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে ভোজপুর ও দক্ষিণাঞ্চলের বুন্দেলঘন্ড রাজ্য, অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ও ডুয়ার্সকে নিয়ে গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের আন্দোলন অব্যাহত আছে।
অর্থনৈতিক কারণ –
ভারতে ভারতের সকল অঙ্গরাজ্য অর্থনৈতিক সম্পদ সামর্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সমপর্যায়ভুক্ত নয়। এই কারণে অর্থাৎ জাতীয় সম্পদের অসম বন্টন সংক্রান্ত বিক্ষোভ সূত্রে আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হতে দেখা যায়। অসম আঞ্চলিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক শোষণ, বেকার সমস্যার বৃদ্ধি ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলনের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।
ভারতে যে সমস্ত আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলন অর্থনৈতিক কারণে গড়ে উঠেছে সেগুলি হল আন্তঃরাজ্য নদী জলবণ্টন নিয়ে বিরোধ, অঙ্গরাজাগুলির অধিকতর স্বাধীনতার দাবী সম্বলিত আন্দোলন, সংরক্ষণ সম্পর্কিত আন্দোলন, ভূমিপুত্রের বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত আন্দোলন, বহিরাগতদের বিতাড়ন আন্দোলন, কৃষিজীবী ও শ্রমিক সাধারণের বিভিন্ন আন্দোলন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ভারতের সকল অঙ্গরাজ্যগুলির আর্থিক সঙ্গতি সমান নয়। এক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য বর্তমান। উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে অঙ্গরাজ্যগুলি অবস্থিত। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে পাঞ্জাব সবথেকে উন্নত বা অগ্রসর প্রাপ্ত অঙ্গরাজ্য। পাঞ্জাবে দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থিত মানুষের সংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কম। পাঞ্জাবের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ভারতের অন্যান্য উন্নত অঙ্গরাজ্যগুলি হল হরিয়ানা, তামিলনাডু, কর্নটিক, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট। এই সমস্ত অঙ্গরাজ্যের অধিবাসীদের মাথাপিছু জাতীয় আয় অধিক। কেন্দ্র উন্নত অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য অধিক সম্পদ সরবরাহ করে- এই অভিযোগ অনুন্নত অঙ্গরাজ্যগুলির। অপরদিকে অগ্রসর অঙ্গরাজ্যগুলির অভিযোগ হল তাদের সম্পদ সামগ্রী অনগ্রসর অঙ্গরাজ্যগুলিতে পরোক্ষভাবে স্থানান্তরিত হয়।
রাজনৈতিক কারণ
আঞ্চলিকতাবাদের রাজনৈতিক কারণগুলি বিভিন্ন রকমের অর্থাৎ আঞ্চলিকতাবাদ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক কারণগুলি নিম্নলিখিতভাবে বিকাশ লাভ করে। কারণগুলি হল- (ক) আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। (খ) বিভিন্ন ধরণের প্রতিবাদী আন্দোলন। (গ) বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন।
(ক) আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল :– ভারতে আঞ্চলিকতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্তমান। মৌলিক ও আবেগ অনুভূতিতে অনুপ্রাণিত প্রতিটি জনগোষ্ঠী পৃথক একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ভিত্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করে। সনাতন অভিন্নতার আবেগ এক্ষেত্রে একটি প্রবল শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবী নিয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের আবির্ভাব ঘটে। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে এইরকম বেশ কিছু দল বর্তমান।
এই সমস্ত দল মিজো, নাগা, বড়ো প্রভৃতির জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। পশ্চিমবঙ্গের গোর্খাল্যান্ড এবং ঝাড়খন্ড হল অনুরূপ প্রকৃতির আঞ্চলিক দল। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার সীমান্তবর্তী সাঁওতাল উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের সাঁওতাল উপজাতিদের নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠন করাই ছিল এই আঞ্চলিক দলটির উদ্দেশ্য। গোর্খাল্যান্ডের উদ্দেশ্য হল দার্জিলিং-এ ভারতীয় নেপালীদের জন্য গোর্খাল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা।
আঞ্চলিক দলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হল অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেগু দেশম, তামিলনাডুর ডি.এম.কে., পাঞ্জাবের আকালী দল, আসামের অসম গণপরিষদ, এই সমস্ত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে অঙ্গরাজ্য সরকার পরিচালনা করে। আবার সরকারী ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও রাজ্য রাজনীতিতে এই সমস্ত দল কর্তৃত্বমূলক ভূমিকা গ্রহণ করে। বর্তমান ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১/৪ অংশ এই সমস্যা।রাজনৈতিক দলের দ্বারা শাসিত হয়ে থাকে।
(খ) বিভিন্ন ধরণের প্রতিবাদী আন্দোলন: রাজনৈতিক আঞ্চলিকতাবাদ প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রকৃতি মুক্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে অন্যান্য অঙ্গরাজ্য থেকে আগত পরিব্রাজনকারীদের বিরুদ্ধে বা বহিরাগতদের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং অঙ্গরাজ্যের মধ্যেই আঞ্চলিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আন্দোলনের কথা বলা যায়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে অসম ও উত্তর পূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ‘বহিরাগত বিতাড়ন আন্দোলন’ সংঘটিত হয়েছে।
আবার পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-এ ভারতীয় নেপালীদের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন এবং মহারাষ্ট্রের মারাঠা ও কাশ্মীরের জম্মু অঞ্চলের আন্দোলনের মধ্য থেকে আঞ্চলিক স্বাধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের এলিটরাই রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সহায় সম্পদের অংশীদার হওয়ার জন্য এই সমস্ত আঞ্চলিক আন্দোলন সংগঠিত করে।
সাধারণত জীবনধারণগত অভিন্নতা, জাতিগত স্বাতন্ত্র্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাধীনতা প্রভৃতি বিচার বিবেচনার মাধ্যমে এই ধরণের প্রতিবাদী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা হয় এবং প্রায়শই এই ধরণের আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে জঙ্গি কার্যকলাপের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়।
(গ) বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন: আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলন হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনও হল একটি অন্যতম রাজনৈতিক কারণ। জাতিগত, সম্প্রদায়গত ও অঞ্চলগত বিচার বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হতে দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের, অধিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আশা আকাঙ্খার পরিতৃপ্তির প্রতিশ্রুতি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের অঙ্গীকার এই ধরনের আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে।
উদাহরণ হিসেবে নাগাল্যান্ডের নাগা, খাসি ও গারোদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মিজোরামের মিজোদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, তামিলনাডুতে ডি.এম.কে.- এর আন্দোলন, পাঞ্জাবের খালিস্থান আন্দোলনের কথা বলা যায়।
====>>> অঞ্চল সম্পর্কে আলোচনা




