অতীত ইতিহাস ( B.A )

ভারতের ইতিহাসে মৌর্যযুগের গুরুত্ব আলোচনা কর।

ভারতের ইতিহাসে মৌর্যযুগের গুরুত্ব : প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থান একটি গৌরবময় যুগান্তকারী ঘটনা। যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে এই রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল এবং যেভাবে কঠিন বিরুদ্ধতার সঙ্গে সংগ্রাম করে এই সাম্রাজ্য আপন শক্তি বৃদ্ধি করেছিল, তা নিঃসন্দেহেই বিস্ময়কর। আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের পরে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৈদেশিক আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল।

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ভারতবর্ষকে কেবলমাত্র বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকেই মুক্ত করেন নি, তিনি ভারতবর্ষে একটি সুসংহত সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এই সাম্রাজ্য স্থাপন এবং তার প্রশাসনের জন্য একটি সুপরিকল্পিত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন ভারতবর্ষের পরবর্তী রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থার উন্নতি বিধানে মৌর্যদের ভূমিকা প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।

ভারতের ইতিহাসে মৌর্যযুগের গুরুত্ব

ভারতের ইতিহাসে মৌর্যযুগের গুরুত্ব আলোচনা কর।

ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য উপাদানের সূচনা

প্রথমত, ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মৌর্য বংশের উত্থান ভারতে নতুন যুগের সূচনা করে। ভারতের প্রাক্-মৌর্য যুগের ইতিহাস রচনা আয়াসসাধ্য। সমসাময়িক নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যের অভাবে প্রার্ক-মৌর্য যুগের ইতিহাস বহুল পরিমাণে পরস্পরবিরোধী উপাদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেই যুগ সম্বন্ধে বৈদেশিক ঐতিহাসিকদের যে সমস্ত বিবরণ পাওয়া যায় তা জনশ্রুতির ওপর নির্ভরশীল।

দেশীয় রচনাও পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক রচনা নয়। এই অবস্থায় প্রাক্-মৌর্য যুগে ধারাবাহিক ইতিহাস কিংবদন্তীমূলক ধারণার ওপর নির্ভরশীল। নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উপাদানের অভাব এই যুগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। মৌর্য যুগে এবং তার পরবর্তীকালে যে সমস্ত বিদেশী লিখিত বিবরণ রেখেগেছেন তা বহুল পরিমাণে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল। দেশীয় রচনাতেও কিছু মূল্যবান তথ্য রয়েছে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও মেগাস্থেনিসের বিবরণ থেকে মৌর্য শাসনব্যবস্থার নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায়। আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের পর গ্রীক ঐতিহাসিকগণও ভারত সম্বন্ধে বহু মূল্যবান তথ্য রেখে গেছেন। এ ছাড়া মৌর্য সম্রাটদের বিশেষতঃ সম্রাট অশোকের শিলালেখ শুধু ধারাবাহিক ইতিহাস গঠনে নয়, সেই সময়ের সামাজিক এবং ধর্মীয় ইতিহাস গঠনেও সাহায্য করে। সুতরাং মৌর্যযুগ থেকে ভারতের প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাসের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধরা হয়।

এদিক দিয়ে মৌর্য যুগ নিশ্চয়ই অন্ধকারময় যুগের অবসান ঘোষণা করে ও আলোকে উত্তরণের পথের ইঙ্গিত দেয়।

রাষ্ট্রনৈতিক দর্শনের উদ্ভব

দ্বিতীয়ত, মৌর্য সম্রাটদের শাসনকালেই ভারতবর্ষে প্রথম সুসংবদ্ধ ও বাস্তব রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা দর্শনের উদ্ভব ঘটে। ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে’ যে বাস্তব রাজনৈতিক দর্শন, রাজকর্তব্য ও প্রশাসনিকব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় তা পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপের ম্যাকিয়াভেলির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে’ই রাজার অপ্রতিহত ক্ষমতা ও রাজাপ্রজার চুক্তি সম্পর্কের (contract) সন্ধান পাওয়া যায়।

সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি: রাজনৈতিক ঐক্যের সূত্রপাত

তৃতীয়ত, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে মৌর্যরাই প্রথম একটি ঐক্যবিধানকারী শক্তিরূপে আবির্ভূত হয় ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ঐতিহ্য সৃষ্টি করে। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং সমগ্র ভারতে এর বিস্তৃতি। ভারতে রাজনৈতিক ঐক্যের সূচনা করে। বিশাল সাম্রাজ্যের নানা বিবদমান অংশকে একই শাসনের অধীনে নিয়ে এসে মৌর্যরাই প্রথম ভারতীয় জাতীয় ঐক্যের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেন।

যদিও পরবর্তীকালে এই সাম্রাজ্যগত ঐক্য (Imperial Unity) ধ্বংস হয়ে যায়, তবুও নতুন নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দ্বারা রাজনৈতিক ঐক্য আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদিক দিয়ে মৌর্য সাম্রাজ্য নতুন সাম্রাজ্যিক ঐক্য স্থাপনের পথিকৃৎ।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে: বৌদ্ধধর্মের পৃথিবীব্যাপী বিস্তার

চতুর্থত, ধর্মীয় ক্ষেত্রে মৌর্য যুগ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। ধর্মের মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রশাসনিক ও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সার্থক প্রয়োগ মৌর্য যুগেই প্রথম লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধধর্মের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহামতি অশোক সর্বপ্রথম মানবপ্রীতি ও অহিংসার নীতিকে দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন ও পররাষ্ট্র নীতিতে প্রয়োগ করেন।

বৌদ্ধধর্ম তাঁর আমলেই একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পরিণত হয় এবং যুদ্ধবিজয়ের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক বিজয়ের পথ প্রশস্ত হয়। যে বৌদ্ধধর্ম এতদিন উত্তর ভারতের একটি অঞ্চলের চতুঃসীমায় আবদ্ধ ছিল, তা অশোকের প্রচেষ্টার ফলে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান মানবধর্মে পরিণত হয়েছিল ও ভারত-সংস্কৃতির প্রসারে সাহায্য করেছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে মৌর্য সম্রাট অশোক প্রথম ভারতের সংস্কৃতিকে বিশ্বমানবের আচরণযোগ্য মানবনীতিতে পরিণত করেন।

সুসংহত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা

পঞ্চমত, মৌর্যদের আমলেই ভারতবর্ষে প্রথম একটি সুসংহত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। রাজকীয় ক্ষমতার ইতিহাসে এই যুগ নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে। রাজা একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন এবং তিনি প্রশাসন, আইন-প্রণয়ন ও বিচারব্যবস্থার সর্বপ্রধান উৎসরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু ওই একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রয়োগে মৌর্যরাজারা স্বেচ্ছাচারী না হয়ে পিতৃসুলভ শাসনের (paternal administration) নীতি গ্রহণ করেছিলেন।

শিল্প স্থাপত্য ও ভাস্কর্য

ষষ্ঠত, শিল্প, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও মৌর্য যুগ ভারতবর্ষের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছিল। প্রায় অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী অশোকের রাজত্বকালে যে শিল্প ও সৌন্দর্যকলার প্রসার ঘটেছিল তা নজিরবিহীন। পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদ, সারনাথ প্রভৃতি স্থানে বৌদ্ধস্তূপগুলি ও অশোকের লেখ উৎকীর্ণ কারুকার্যখচিত মসৃণ ও সু-উচ্চ শিলাস্তম্ভগুলি তাঁদের নির্মাণ কৌশলের জন্য আজও মানুষের বিস্ময় উদ্রেক করে।

বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক

সর্বশেষে, বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে মৌর্য যুগ নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত করে। প্রাক্-মৌর্য যুগে ভারতের সঙ্গে বহির্বিশ্বের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য ছিল না। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে গ্রীক সেনাপতি সেলুকাসের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন অশোকের বৌদ্ধধর্ম প্রচার এবং বিদেশে দূত প্রেরণের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বহির্বিশ্বের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সম্রাট অশোক নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম কৃতী সম্রাটরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মূল্যায়ন

মৌর্য যুগের আবির্ভাব ভারতের ইতিহাসে সামগ্রিকভাবেই এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাস যেন বহুযুগের অন্ধকার দূর করে এক নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল। অনুমানভিত্তিক ইতিহাসের পরিবর্তে প্রাচীন ভারতবর্ষের তথ্যনির্ভর ইতিহাস রচনার পথ প্রশস্ত হয়।

মৌর্যসম্রাটগণ বিভিন্ন গোষ্ঠীতন্ত্র ভেঙ্গে দেশে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করেন ও একটি মানবিক ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবনের সূচনা করে তাঁরা ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি নতুন সামাজিক জীবনের উদ্বোধন করেন। এই সমস্ত দিক্ বিবেচনা করে ঐতিহাসিক ভিন্সেন্ট স্মিথ যথার্থই বলেছেন যে মৌর্য যুগ ভারতবর্ষকে অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে এসেছে (“The advent of Maurya dynasty marks the passage from darkness to light.”-Vincent Smith)।

=====>>> খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে নন্দ বংশের পতন মগধের সাম্রাজ্য বিস্তার

RANI250

My name is Rani Biswas, a web designer with six years of experience and the owner of dishacoachingcentre.com, a dedicated educational platform offering high-quality learning resources.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button