রাজ্যসভার গঠন এবং ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

রাজ্যসভার গঠন : ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষ হল রাজ্যসভা। সংবিধানের ৮০ নং ধারা অনুযায়ী, অনধিক ২৫০ জন সদস্য নিয়ে রাজ্যসভা গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সাধারণত আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যগুলির সমপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয়। ভারতে এই নীতিটি স্বীকৃত হয়নি। এখানে রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে রাজ্যসভার আসনসংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
বর্তমানে রাজ্যসভার মোট সদস্যসংখ্যা হল ২৪৫। এদের মধ্যে ১২ জন সদস্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত। সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা, সমাজসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কৃতী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি এই ১২ জন সদস্যকে মনোনীত করেন। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই মনোনয়ন করে থাকেন। অবশিষ্ট সদস্যরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে নির্বাচিত হন।
সংবিধানের ৮০(৪) নং ধারা অনুযায়ী এই নির্বাচন ব্যবস্থা একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নিয়মানুযায়ী পরিচালিত হয়। অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রে বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা এবং কেন্দ্রশাসিত অন্যলের ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট প্রণীত আইন অনুযায়ী গঠিত নির্বাচক সংস্থার প্রতিনিধিরা রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচন করেন।
রাজ্যসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি

রাজ্যসভার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও কার্যাবলি হল-
[1] আইন প্রণয়ন
পার্লামেন্টে সাধারণ বিল পাসের ব্যাপারে রাজ্যসভার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা রয়েছে। রাজ্যসভা যে-কোনো সাধারণ বিল উত্থাপন করতে পারে। রাজ্যসভার অনুমোদন ছাড়া কোনো সাধারণ বিল পার্লামেন্টে পাস হয় না। কোনো বিল নিয়ে রাজ্যসভা ও লোকসভার মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন।
অর্থ বিলের ব্যাপারে রাজ্যসভার কোনো প্রকৃত ক্ষমতা নেই। কোনো অর্থ বিল প্রত্যাখ্যান করা বা সংশোধন করার ক্ষমতা রাজ্যসভার নেই। রাজ্যসভায় অর্থ বিল পাঠানো হয় শুধুমাত্র অনুমোদনের জন্য। রাজ্যসভাকে ১৪ দিনের মধ্যে অর্থ বিল সম্পর্কে তার মতামত জানাতে হয়।
[2] সংবিধান সংশোধন
রাজ্যসভার হাতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতাও রয়েছে। তবে এই ক্ষমতা রাজ্যসভা যৌথভাবে লোকসভার সঙ্গে ভোগ করে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী বিলের পাঁচটি ধারা রাজ্যসভার অনুমতির অভাবে বাতিল হয়ে যায়।
[3] নির্বাচন ও অপসারণ
রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও পদচ্যুতির বিষয়ে এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্যসভার সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতা রাজ্যসভা যৌথভাবে লোকসভার সঙ্গে ভোগ করে থাকে। তবে উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যুতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে রাজ্যসভা একক ক্ষমতার অধিকারী। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক প্রমুখ পদাধিকারীদের অপসারণের ক্ষেত্রেও রাজ্যসভার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা রয়েছে।
[4] রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব উত্থাপন
রাজ্যসভার উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ যদি প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, জাতীয় স্বার্থে রাজ্য-তালিকার কোনো বিষয়ে পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন, তাহলে পার্লামেন্ট সে-বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে।
[5] সর্বভারতীয় কৃত্যক গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন
রাজ্যসভায় উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে যদি এরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় যে, জাতীয় স্বার্থে পার্লামেন্টের এক বা একাধিক সর্বভারতীয় কৃত্যক (All India Services) গঠন করা দরকার, তাহলে পার্লামেন্ট সে-বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার অধিকারী হতে পারে।
[6] অন্যান্য ক্ষমতা
অন্যান্য যেসব বিষয়ে রাজ্যসভা ক্ষমতা ভোগ করে, সেগুলি হল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘোষিত জরুরি অবস্থা অনুমোদন, অঙ্গ-রাজ্যের নাম ও সীমানা পরিবর্তন, অঙ্গরাজ্যে বিধান পরিষদ সৃষ্টি বা বিলোপ, হাইকোর্টের এক্তিয়ার বৃদ্ধি প্রভৃতি।
উপসংহার
রাজ্যসভার ক্ষমতার পর্যালোচনা করতে গিয়ে কে ভি রাও বলেন, রাজ্যসভার গঠনপ্রকৃতি পক্ষপাতদুষ্ট। এই কারণে রাজ্যসভা কখনও কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। সমালোচকদের মতে, এর ফলে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। অঙ্গরাজ্যগুলির সমপ্রতিনিধিত্বের নীতি গৃহীত না হওয়ায় জনবহুল রাজ্যের প্রতিনিধিরা সংখ্যাধিক্যের জোরে বিশেষ প্রাধান্য ভোগ করে থাকেন। তা ছাড়া রাজ্যসভার সদস্যদের পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিও অগণতান্ত্রিক বলে সমালোচকরা মনে করেন।
====>>> ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য


