ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা বিশ্লেষণ করো।

ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা : ভারতীয় পার্লামেন্ট সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এক ব্যাপক সাংবিধানিক ক্ষমতার অধিকারী। তবে ভারতীয় পার্লামেন্টের এই ক্ষমতা অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত নয়। ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদাকে অনেক সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের সঙ্গে তুলনা করে বিচারবিশ্লেষণ করা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় পার্লামেন্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো ব্যাপক সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়, আবার মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের মতো দুর্বল প্রকৃতিরও নয়। বিষয়টি এখানে পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।
ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা –

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ভারতীয় পার্লামেন্ট
সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ঐতিহ্যপূর্ণ প্রাচীন দেশ হল গ্রেট ব্রিটেন। ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বলতে নিম্নকক্ষ কমন্সসভা এবং উচ্চকক্ষ লর্ডসভাসহ রাজা বা রানিকে বোঝায়। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অসীম ক্ষমতা রয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রণয়ন করা আইনের বৈধতা সম্পর্কে ব্রিটিশ আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যায় না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রণীত যাবতীয় আইন আদালতের কাছে বৈধ বলে বিবেচিত হয়।
ব্রিটেনের বিচার বিভাগ পার্লামেন্টের আইনকে ব্যাখ্যা করতে পারলেও তাকে বাতিল করতে পারে না। এভাবে ব্রিটেনে পার্লামেন্টের অপ্রতিহত ক্ষমতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণে ব্রিটিশ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডাইসি মন্তব্য করেছিলেন যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যদি এমন আইন প্রণয়ন করে যে, নীল চোখবিশিষ্ট সব শিশুকে হত্যা করা হবে তাহলে সেই আইনের বিরোধিতা করার ক্ষমতা কারুর নেই।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই অনিয়ন্ত্রিত এবং অপ্রতিহত ক্ষমতা ভারতীয় পার্লামেন্টের নেই। ভারতীয় পার্লামেন্টকে সংবিধানের অধীনে থেকে কাজ করতে হয়। সংবিধানকে লঙ্ঘন করে কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভারতীয় পার্লামেন্টের নেই। ভারতীয় পার্লামেন্ট-প্রণীত আইনের বৈধতা বিচার করে দেখার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে। সংবিধানে এই ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টকে দেওয়া হয়েছে।
ভারতের পার্লামেন্টের কোনো আইন যদি সংবিধানকে লঙ্ঘন করে তাহলে সেই আইনকে বাতিল করার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে। বস্তুত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় পার্লামেন্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলায় (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে) এই প্রসঙ্গে স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করে বলা হয়েছিল ।
ভারতীয় সংবিধান ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার অনেক নীতি গ্রহণ করলেও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতার নীতিকে স্বীকৃতি দেয়নি। বস্তুত ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের বদলে সংবিধানের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
মার্কিন কংগ্রেস ও ভারতীয় পার্লামেন্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সে দেশের বিচার বিভাগের শীর্ষ আদালত সুপ্রিমকোর্টকে মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের ওপর স্থান দেওয়া হয়েছে। মার্কিন আইন বিভাগ কংগ্রেসের প্রণয়ন করা যে-কোনো আইনকে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অথবা ন্যায়নীতি লঙ্ঘনের দায়ে বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে।
অনেকে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টকে সে দেশের আইনসভার ‘অনির্বাচিত শক্তিশালী তৃতীয় কক্ষ’ বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চার্লস হিউজেস মন্ডব্য করেছিলেন “আমরা সংবিধানের অধীন, কিন্তু বিচারপতিরা যা বলেন তাই সংবিধান” (“We are under the constitution, but the constitution is what the Judges say it is.”)
প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় সুপ্রিমকোর্টের হাতে এরকম কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সুপ্রিমকোর্ট শুধুমাত্র সংবিধান লঙ্ঘনের কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে পার্লামেন্টের আইনকে বাতিল করতে পারে না। ভারতীয় সংবিধানে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
সংবিধান অনুসারে কোনো বিভাগের ক্ষমতা অসীম বা অনিয়ন্ত্রিত নয়। তবে ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা মার্কিন আইনসভার মতো দুর্বল প্রকৃতির নয় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় আইন বিভাগ পার্লামেন্টের হাতে সরকার গঠনের যে চূড়ান্ত ক্ষমতা রয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় কোনোভাবেই দেখা যায় না।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করে সরকারের পতন ঘটানোর ব্যাপারেও ভারতের আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভা যে ক্ষমতা ভোগ করে তা মার্কিন আইনসভার নিম্নকক্ষ জনপ্রতিনিধি সভার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মূল্যায়ন
ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদার বিচারবিশ্লেষণের বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল, আপাতদৃষ্টিতে যে ক্ষমতা ভারতীয় পার্লামেন্টের হাতে রয়েছে তা অনেকটাই তত্ত্বগত ক্ষমতা। কার্যত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে এই ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।
সংসদীয় ব্যবস্থার পীঠস্থান গ্রেট ব্রিটেনে বহুকাল আগেই ক্যাবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতেও সেই ধারা লক্ষ করা যায়। আধুনিক বিশ্বের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দেশগুলিতে যেভাবে দলব্যবস্থা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের প্রতিনিধিত্বকারী কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটই শেষকথা বলার অধিকারী।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রিটেনে যেহেতু কোনো লিখিত সংবিধান নেই এবং ‘বিচারবিভাগীয় সমীক্ষার নীতিরও কোনো স্বীকৃতি সে দেশে নেই, তাই সেখানে পার্লামেন্ট চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পেরেছে। ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে এ দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার আদর্শ প্রতিনিধি, এই কারণে প্রকৃতিগতভাবে সে দেশের আইন বিভাগ সংসদীয় শাসনব্যবস্থার আইন বিভাগের চেয়ে যথেষ্ট দুর্বল প্রকৃতির।
উপসংহার
সবশেষে বলা যায়, ভারতের পার্লামেন্ট হল দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে থেকে পার্লামেন্টকে এই কাজ করতে হয়। তাই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ভারতীয় সংবিধানকে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী বলা যেতে পারে।


